বিশ্বের অন্যতম পরিচিত বোর্ড গেমগুলোর মধ্যে একটি, যা জনপ্রিয়তায় বিখ্যাত গো-কেও ছাড়িয়ে গেছে, সেটি হলো শোগি (将棋), বা “জাপানি দাবা”। এই খেলাটিও দুইজন খেলোয়াড় দ্বারা খেলা হয়, একটি বর্গাকার বোর্ডে সাদা ও কালো ঘুঁটি দিয়ে।
তবে ক্লাসিক দাবার তুলনায়, শোগিতে প্রথমে চাল দেয় কালো ঘুঁটির খেলোয়াড় — যাকে বলা হয় “সেন্টে” (先手, অর্থাৎ “যে আগে চলে”), আর দ্বিতীয় খেলোয়াড় — সাদা ঘুঁটির, হয় “গোতে” (後手, অর্থাৎ “যে পরে চলে”)। ঘুঁটির ধরন, চলাফেরা ও মূল্য এখানে আলাদা, এবং বোর্ডের আকার ৮×৮ তে সীমাবদ্ধ নয় — এটি ৩৬×৩৬ ঘর পর্যন্ত বড় হতে পারে!
খেলার ইতিহাস
ঠিক কখন শোগির উৎপত্তি হয়েছে তা জানা যায় না, তবে নিশ্চিতভাবে এটি জাপানে উদ্ভূত হয়েছে — আনুমানিক ৭৯৪ থেকে ১১৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় “নতুন সারুগাকু নথিপত্র” (新猿楽記) নামক একটি গ্রন্থে, যা লিখেছেন হেইয়ান যুগের (平安時代) জাপানি রাজদরবারের পণ্ডিত ফুজিওয়ারা নো আকিহিরা (藤原明衡)। এই গ্রন্থে শোগির নিয়ম বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তখনই এই গেম “ছোট শোগি” ও “বড় শোগি”-তে বিভক্ত ছিল। ছোট শোগি খেলা হতো ৯×৯ বোর্ডে, আর বড়টি ১৩×১৩ তে।
আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, শোগির উৎপত্তি সম্ভবত ভারতের প্রাচীন খেলা চতুরঙ্গা থেকে, যেমন ক্লাসিক দাবার ক্ষেত্রেও হয়েছে। প্রথমে চতুরঙ্গা ভারত থেকে পারস্যে গিয়ে “শতরঞ্জ”-এ রূপান্তরিত হয়, পরে তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ভিত্তিতে তৈরি হয় শিয়াংচি (象棋, চীন), চ্যাঙ্গি (장기, কোরিয়া) এবং শোগি (জাপান)।
নারা অঞ্চলে পাওয়া শোগির প্রাচীনতম ১৬টি ঘুঁটি খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর। এই ঘুঁটিগুলো ছিল সমতল পঞ্চভুজ আকৃতির, যার ওপরে জাপানি অক্ষর খোদাই করা। যদিও ঘুঁটির গঠন অপরিবর্তিত থেকেছে, বিভিন্ন যুগে বোর্ডের আকার অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন ১১৮৫ থেকে ১৫৭৩ সালের মধ্যে, শোগি খেলা হতো ৩৬×৩৬ পর্যন্ত বড় বোর্ডে এবং একসাথে ৮০৪টি ঘুঁটি ব্যবহার করা যেত। ফলে এই খেলা হয়ে ওঠে অত্যন্ত জটিল, এবং অনেকভাবে পশ্চিমা দাবাকে ছাড়িয়ে যায়।
শোগির বিভিন্ন সংস্করণ ছিল: যেমন, দাই শোগি (大将棋, ১৫×১৫), চু শোগি (中将棋, ১২×১২), দাই দাই শোগি (大大将棋, ১৭×১৭) এবং তাইকিওকু শোগি (大局将棋, ৩৬×৩৬)। এসব সংস্করণে শুধু স্মরণশক্তি ও কৌশলী চিন্তাভাবনা নয়, একেকটি ম্যাচ সম্পন্ন করতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বা এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত সময় লাগতো।
ষোড়শ শতাব্দীতে, জাপানি সম্রাট গো-নারা (後奈良天皇) শোগিকে সহজ করে তোলেন এবং একে আধুনিক রূপ দেন। এরপর থেকে এটি নির্দিষ্ট ৯×৯ বোর্ডে ৪০টি ঘুঁটি নিয়ে খেলা শুরু হয়। গো-নারা একটি মৌলিক নিয়ম সংযুক্ত করেন — তা হলো, নির্দিষ্ট শর্তে প্রতিপক্ষের দখলে নেওয়া ঘুঁটি নিজের হয়ে ব্যবহার করার সুযোগ। এই নিয়মই শোগিকে সত্যিকারের অনন্য করে তোলে এবং এটিকে শুধু দাবার আরেক সংস্করণ হিসেবে নয়, সম্পূর্ণ আলাদা একটি গেম হিসেবে চিহ্নিত করে।
এই নিয়মের ফলে শোগি শুধুমাত্র কৌশলনির্ভর নয়, বরং এমন একটি খেলা হয়ে ওঠে যা মানসিক নমনীয়তাও দাবি করে: খেলোয়াড়কে শুধু নিজের ঘুঁটি নয়, এমন ঘুঁটিও ভাবতে হয়, যা ভবিষ্যতে তার বিপক্ষে ব্যবহৃত হতে পারে। এই গতিশীলতা কৌশলের পরিসরকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
শোগি সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল জাপানে ১৭শ শতকের শুরু থেকে ১৯শ শতকের শেষ পর্যন্ত। এটি ছিল শোগুনদের (সামরিক শাসক) প্রিয় বিনোদন, এবং সেরা খেলোয়াড় পেতেন “মেইজিন” (名人, অর্থাৎ “মহান মাস্টার”) উপাধি এবং তাকে সরকারিভাবে শোগি মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হতো। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শোগি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা হারায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁতিতে পড়ে।
জাপান সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার ভাবনার পেছনে কারণ ছিল — শোগিতে দখলকৃত ঘুঁটি ব্যবহার করা — যা বন্দিদের সঙ্গে তুলনার অনুভূতি জাগাতো। তবে সেই সময়ের শোগি মাস্টার মাসুদা কোজো (升田幸三) এই খেলার পক্ষে সফলভাবে যুক্তি দেন। তিনি উদাহরণ দেন যে, দাবাতে ঘুঁটি “মারা” যায়, কিন্তু শোগিতে তা “দখল” হয় এবং পুনরায় ব্যবহৃত হয় — যা তুলনামূলকভাবে কম হিংসাত্মক।
মাসুদা কোজো শুধু কর্তৃপক্ষকে রাজি করাননি, তিনি প্রদর্শনী ম্যাচ আয়োজন করেন, সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লেখেন এবং বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পান। তার প্রচেষ্টার কারণে শোগি শুধু রক্ষা পায়নি, বরং যুদ্ধোত্তর সময়ে নতুন করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
মজার তথ্য
শোগি একটি শতাব্দীপ্রাচীন জাপানি খেলা, যার চারপাশে বিগত ৯০০ বছরে জমে উঠেছে অসংখ্য মজার ঘটনা। যেমন:
- সাধারণ ধারণার বিপরীতে, বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় "দাবা-জাতীয়" খেলা হলো শোগি, দাবা নয় — যার উৎপত্তি ভারতীয় চতুরঙ্গা থেকে।
- জাপানে ১৭ই নভেম্বর সরকারি ভাবে “শোগি দিবস” হিসেবে পালিত হয়। এই প্রথা শুরু হয়েছিল ১৭শ শতকে, যখন সেরা খেলোয়াড়রা শোগুনের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলতেন।
- খেলোয়াড়দের দক্ষতার ভিত্তিতে “ড্যান” (段) উপাধি দেওয়া হয় “কিউ-ড্যান” (級—段) পদ্ধতিতে: এতে থাকে শৌখিন, পুরুষ পেশাদার ও নারী পেশাদার শ্রেণি।
- জাপানে একটি বিশেষ শোগি স্কুল আছে, যেখানে কেবল ২০ বছরের বেশি বয়সী ও পঞ্চম শৌখিন ড্যান-প্রাপ্ত ছাত্রদেরই ভর্তি নেওয়া হয়।
- ১৯৯০ থেকে ২০০০-এর দশকে, সবচেয়ে সফল খেলোয়াড় ছিলেন জাপানি ইয়োশিহারু হাবু (羽生善治), যিনি ৯৯টি শিরোপা জিতেছেন। আর ২০২০-এর দশকে এখন পর্যন্ত শীর্ষে রয়েছেন সোটা ফুজিই (藤井聡太)।
- সোটা ফুজিই ইতিহাসের সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড় যিনি ২১ বছর বয়সে মেইজিন উপাধি পান — যা অর্ধ শতকেরও বেশি পুরোনো রেকর্ড ভেঙে দেয়। তিনি ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় যিনি একসাথে সাতটি প্রধান শিরোপা জেতেন।
২০২৫ সালের হিসেবে, অন্তত ২ কোটি মানুষ শোগি খেলেন — শৌখিন ও পেশাদার স্তরে মিলিয়ে। এটি রেনজু ও গো খেলার চেয়ে অনেক বেশি। শোগিকে যথার্থভাবেই বলা যায় বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বোর্ড গেম — শুধু জাপানে নয়, সারা বিশ্বে।
এই খেলা কেবল কৌশলগত চিন্তা বিকাশ করে না, এটি জাপানের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত করে তোলে। যারা একবার খেলেন, তারা আজীবন শোগির ভক্ত হয়ে থাকেন।