লুডো একটি সুপরিচিত বোর্ড গেম, যা দুটি বা চারজন খেলোয়াড় রঙিন গুটি এবং একটি পাশা ব্যবহার করে খেলে থাকে। এই খেলাটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় ভারতে, ইউরোপে এবং দক্ষিণ আমেরিকায়। এটি বিভিন্ন সংস্করণে পাওয়া যায় এবং এর অনেকগুলো নাম রয়েছে, যার মধ্যে কিছু নাম মূলত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর দ্বারা ট্রেডমার্ক হিসেবে নিবন্ধিত।
খেলার ইতিহাস
ল্যাটিন শব্দ ludo এর অর্থ “আমি খেলি”, কিন্তু এই নামটি খেলার উদ্ভবের অনেক পরে এসেছে — যখন খেলা দক্ষিণ এশিয়া থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। লুডোর ঐতিহাসিক উৎস হলো ভারত, যেখানে এটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই খেলা হয়ে আসছে — যদিও তখন পাশা ব্যবহার করা হতো না।
এই খেলার চূড়ান্ত সংস্করণ, যেখানে খেলোয়াড়রা পালাক্রমে পাশা নিক্ষেপ করে, ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ডে আলফ্রেড কোলিয়ার দ্বারা পেটেন্ট করা হয় এবং Royal Ludo নামে বাজারে আনা হয়, যা এর “রাজকীয়” বোর্ড গেম হিসেবে মর্যাদা তুলে ধরে।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে এই বোর্ড গেমটি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নাবিকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। নিয়মে কিছু পরিবর্তনের পর এটি একটি নতুন ইংরেজি নাম পায় — Uckers। সুইডেনে একটি সংস্করণ Fia (সম্পূর্ণ নাম: Fia med knuff, যার অর্থ “ধাক্কাসহ ফিয়া”) নামে পরিচিত, আর সুইজারল্যান্ডে এটি Eile mit Weile নামে পরিচিত, যার আক্ষরিক অর্থ “ধীরে তাড়াতাড়ি করো”।
অন্যান্য সংস্করণের মধ্যে রয়েছে হাঙ্গেরিয়ান — Ki nevet a végén (“শেষে কে হাসে?”), জার্মান — Mensch ärgere Dich nicht (“মানুষ, রাগ করো না”) এবং ফরাসি — Jeu des petits chevaux (“ছোট ঘোড়ার খেলা”)। স্পেনে এই খেলার রূপান্তরিত নাম হলো parchís, আর কলম্বিয়ায় — parques। এই সংস্করণগুলোর মধ্যে বোর্ডের ডিজাইন, গুটির সংখ্যা এবং নির্দিষ্ট নিয়মের পার্থক্য থাকতে পারে।
অনেক দেশে এই খেলার সঙ্গে স্থানীয় ঐতিহ্য জড়িত — মজার কথা, ভাগ্য কামনার মন্ত্র, কিংবা স্থানীয় জটিল নিয়ম যেমন: প্রতিপক্ষের গুটির ওপর উঠলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে খেলা থেকে বাদ দেওয়া।
যদিও খেলার নাম এবং যান্ত্রিক বিশদ পরিবর্তিত হয়, মূল ধারণাটি এক থাকে। এই খেলার ভারতীয় উৎপত্তি সত্ত্বেও, পশ্চিমা সংস্করণগুলো এর কাঠামো ও চেহারাকে অনেকটা বদলে ফেলেছে, মূল পচিসি থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে — এটি একটি প্রাচীন ভারতীয় বোর্ড গেম যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খেলা হয়ে আসছে।
শুধু পশ্চিমে নয়, লুডো পূর্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনামে এটি Cờ cá ngựa (“সী-হর্স খেলা”) নামে খুবই জনপ্রিয়, এবং চীনা সংস্কৃতিতে একটি অনুরূপ খেলা রয়েছে যার নাম 飞行棋 (“উড়ন্ত দাবা”), যেখানে গুটিগুলো ক্রুশাকার বোর্ডে চলাফেরা করে এবং বিশেষ ঘরের মাধ্যমে “উড়ে যেতে” পারে।
মজার তথ্য
- লুডো প্রাচীন ভারতীয় খেলা পচিসি থেকে উদ্ভূত, যার ইতিহাস ১৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো। এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়, অর্থাৎ ষষ্ঠ শতাব্দীর আশেপাশে খেলা হতো। এর জনপ্রিয়তার প্রমাণ আজও আগ্রার দুর্গের ছাদে খোদাই করা পাথরের খেলার বোর্ডে পাওয়া যায়।
- মূল সংস্করণে পাশার পরিবর্তে কৌরি শাঁস বা বিশেষ কাঠি ব্যবহার করা হতো যা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা হতো। উপরের দিকে উল্টে থাকা দিকগুলো নির্ধারণ করতো কত ঘর এগোতে হবে।
- মোগল সম্রাট আকবর (ষোড়শ শতাব্দী) পচিসি এতটাই পছন্দ করতেন যে তিনি এটি বিশাল পাথরের বোর্ডে জীবন্ত গুটি — দাসদের দিয়ে খেলতেন, যারা গুটির পরিবর্তে চলাচল করত।
- ভারত এবং নাইজেরিয়ার কিছু স্কুলে লুডো বিরতির সময় খেলার জন্য প্রস্তাবিত খেলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
- বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের কিছু স্কুলে এই খেলা সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কারণ ছাত্ররা এটি নিয়ে ঝগড়া করত বা ক্লাস ফাঁকি দিত।
শুধু একবার খেললেই বুঝবেন — লুডো মানুষকে একত্র করে, আনন্দ দেয় এবং সত্যিকারের উত্তেজনা, হাসি এবং জয়ের স্বাদ নিয়ে আসে!